
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর ‘ক্রা*ইম জগতের ড*ন’ মাহবুব হাসানের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসছে ভয়ংকর নানা তথ্য। পুলিশের গাফেলতির কারণে তিনি এখনো ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এতে নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। এ ঘটনায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপে তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি উঠেছে।
সূত্র জানিয়েছেন, মাহবুব হাসানের বাসা রাজবাড়ির পাংশায়। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালীন ছাত্রলীগ করতেন তিনি। সেই সুবাদে ২০১৫ সালে পুলিশে নিয়োগ পান মাহবুব হাসান। এরপর পোস্টিং নেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি)। হাতে ‘নৌকার ট্যাটু’ এঁকে আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ২০১৯ সালে তৎকালীন ডিবির ডেপুটি কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশনায় লক্ষিপুর ডিবি কার্যালয়ে ‘আয়নাঘর’ তৈরি করেন তিনি। আওয়ামী বিরোধী নেতাকর্মীদের আটক করে এনে চালাতেন পাশবিক নির্যাতন। এছাড়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে ক্রাইম জগতের পরিধি বাড়াতে থাকেন হাসান।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর দুপুর দেড়টার সময় নগরীর রেলগেট গোরহাঙ্গা এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. মাসুদ রানা সরকারের বাসায় হানা দেয় মাহবুব হাসানের নেতৃত্বে ডিবি পুলিশের একটি টিম। এসময় তার ছেলে মো. রাজিব আলী রাতুলকে গ্রেপ্তার করেন তিনি। ওইদিন দুপুর ২ টা ১০ মিনিটে কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনযোগে শ^শুরবাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই এসআই হাসান সেখানে যান এবং রাজিবকে গ্রেপ্তার করেন। ভিডিওটি পরে ডিবির হাসান একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। ভিডিওতে দেখা যায়, ডিবি সদস্য শুভংকর একটি ব্যাগ থেকে বের করে ডিবির আরেক সদস্য সুব্রতর হাতে দেন। পরে মাদক মামলায় ফাঁসানো হয় রাজিবকে। ভিডিওর সাথে মামলার এজহারেরও কোনো মিল ছিল না।
সূত্র জানিয়েছে, ওইদিন রাজিবকে সিমলা পার্কে নিয়ে গিয়ে রাজিবের বাবার কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা নেন। মাসুদ রানা সরকারকে হাসান বলেন, ‘যান আপনার ছেলেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ কিন্তু রাজিবকে না ছেড়ে পরে নগরীর লক্ষিপুর ঝাউতলা এলাকায় ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সারারাত তার ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। মাহবুব ইলেকট্রিক শক দেন রাজিবকে। এছাড়া তাকে পেটানোও হয়। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজিব। অসুস্থ রাজিবের জন্য পরদিন সকালে তার মা ওষুধ নিয়ে যান। ওষুধ দেয়ার জন্য ৫ হাজার টাকা নেন পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু ওষুধ পৌঁছানো হয়নি। পা দিয়ে ওষুধ পিষে নষ্ট করে ফেলেন শুভংকর।
সূত্র আরও জানায়, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মতিন পরে রাজিবের বাবাকে ডাকেন এবং আরেকজন আসামি এনে তার সামনে পেটান। এ সময় এসআই মতিন রাজিবের বাবাকে বলেন, টাকা না দিয়ে এভাবে আপনার ছেলেকে পেটানো হবে। রাজিবের বাবার কাছে তারা ৪৫ হাজার টাকা নেন। পরে যদিও ২০২৩ সালে সেই টাকা রাজশাহী সিটি মেয়রের এপিএস শাওনের মাধ্যমে ২৭ হাজার টাকা ফেরত দেন পুলিশ সদস্যরা। ১৫ মাস ২০ দিন কারাগারে থাকার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন রাজিব।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর হাসানের বিরুদ্ধে ৪টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে নগরীর আলুপট্টি এলাকায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশের গুলিতে মহানগর ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক আলী রায়হান নিহত হন। রায়হান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি হাসান। এছাড়া ভুক্তভোগী রাজিব আলীও হাসানের বিরুদ্ধে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলা করেছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নগরীর রেলগেটে মানববন্ধনও হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও পাওয়া গেছে। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের টার্গেট করে আটক করে এনে ক্রসফায়ারের ভয় দেখাতেন। সূত্র জানায়, মাহবুব হাসান আটক বাণিজ্য করে নামে বেনামে সম্পত্তি গড়েছেন। নগরীতে একাধিক বাসার মালিক তিনি। এছাড়া ভদ্রা এলাকায় ১৩ পার্বন রেস্টুরেন্ট করেন। সেখানেই তিনি টাকার লেনদেন করতেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, মাহবুব হাসান এখনো আইনের আওতায় না আসায় তারা আতঙ্কিত। যে কোনো সময়ে তিনি প্রাণনাশ ঘটাতে পারেন বলেও তাদের শঙ্কা। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী রাজিব আলী রাতুল বলেন, আরএমপির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমি সব জানিয়েছি। তিনি আশ্বস্ত করেছেন। হাসানকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া অভিযুক্ত বাকি পুলিশ সদস্যদেরও আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই।
রাজিবের বাবা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. মাসুদ রানা সরকার বলেন, এত অপরাধ করেও হাসানের কোনো অনুশোচনা নেই। উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্য মামলা দায়ের করে তিনি পালিয়েছেন। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারপূর্বক আমরা তার শাস্তি চাই। অভিযুক্ত মাহবুব হাসান পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে আরএমপির মুখপাত্র সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, তার বিরুদ্ধে আমার কাছে অভিযোগ রয়েছে। বিভাগীয় মামলায় তাকে চাকরি থেকে ‘ডিসমিস ফ্রম সার্ভিস’ করা হয়েছে। এটার সুপারিশ অনুমোদনের জন্য পিএসসিতে পাঠানো হয়েছে।