
মো. জনি হাসান:
গাছের ডালে ডালে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা সেই স্বর্ণালি ফলগুলো শুধু আম নয় একেকটি যেন প্রকৃতির সৃষ্টিশীলতার নিদর্শন। গ্রীষ্মের দুপুরে রাজশাহীর আমবাগানে ঢুকলে চোখে পড়বে এক অপরূপ দৃশ্য সবুজ পাতার আড়ালে থোকায় থোকায় ঝুলছে সোনালি-হলুদ আম। গাছ থেকে নামিয়ে একটি আম কাটতেই মুখে ছড়িয়ে পড়ে মিষ্টি রস। এটাই রাজশাহীর আমের জাদু, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করছে।বাংলাদেশের রসনাবিলাসে রাজশাহীর আম যে স্থান দখল করে আছে, তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা।
রাজশাহীর আমের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে পৌঁছাতে হবে মুঘল আমলে। কথিত আছে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে পাঠানো হতো এই অঞ্চলের ফজলি আম। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৯৬ সালে প্রথম ইউরোপে রপ্তানি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে চাষ হয় ১০০রও বেশি প্রজাতির আম। এর মধ্যে ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ আর হিমসাগর সবচেয়ে জনপ্রিয়।
বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল মাটি আর পদ্মার জলে ভেজা এই ভূমি আম চাষের জন্য যেন স্বর্গরাজ্য। পুঠিয়ার হিমসাগর, চারঘাটের ফজলি, বাঘার গোপালভোগ প্রতিটি উপজেলার আমের রয়েছে নিজস্ব পরিচয়। স্থানীয় চাষী মো. শহিদুল্লাহর কথায়, আমাদের আম গাছে জল দেওয়া মানে পদ্মার জলে স্নান করানো। এখানকার মাটি আর পানিই আমকে দেয় ভিন্ন মাত্রা।
২০২১ সালে জিআই সনদ পাওয়ার পর রাজশাহীর আম পেয়েছে বৈশ্বিক স্বীকৃতি। বর্তমানে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এমনকি দক্ষিণ কোরিয়ার সুপারশপের তাকেও জায়গা করে নিয়েছে এই আম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, প্রতি বছর গড়ে ৩,০০০ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয় শুধু রাজশাহী থেকে।
আম রাজশাহীর কৃষি অর্থনীতির চালিকাশক্তি। জেলার ২.৫ লাখ মানুষের আয়ের প্রধান উৎস এই আম চাষ। বছরে গড়ে ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয় শুধু আমকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় ব্যবসায়ী রাশেদা বেগম বলেন, আম এলে আমাদের জীবনেও আসে নতুন রং।
জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় প্রতি বছরই নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। তবে রাজশাহীর আমচাষীরা প্রযুক্তি আর ঐতিহ্যের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন প্রতিরোধ ব্যবস্থা। ড্রিপ সেচ, জৈব সারের ব্যবহার বাড়ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের থেকে বলেন, আমরা প্রস্তুত, রাজশাহীর আমের গৌরব ধরে রাখতে।
রাজশাহীর আম শুধু একটি ফল নয় এটি বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতির অংশ, কৃষকের স্বপ্নের ফসল, রপ্তানি আয়ের উৎস। প্রতিটি কামড়ে মেলে প্রকৃতির দেওয়া সেই অমৃত স্বাদ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাঙালির রসনাকে করেছে পরিতৃপ্ত। রাজশাহীর আমের এই জয়যাত্রা যেন অব্যাহত থাকে এই হোক আমাদের সকলের কামনা।